টোকাই
—- মোঃ তুষার আলী
দুপুর দুইটা বাজে, ভাজা ওয়ালা মামার কাছে মুড়ি ভাজা নিচ্ছি। এমন সময় পেছন থেকে একজন এসে শার্ট টানছে।পেছন ফিরে ধমক দেব এমন সময় একটা নিষ্পাপ চেহারা দেখতে পেলাম।কিছুক্ষণের জন্য কোন কথা বের হলো না মুখ দিয়ে, স্তব্ধ হয়ে রইলাম।এমন মুখ দেখে ধমক দেওয়া যে অসম্ভব। মামা, পাঁচ টা টাকা দেন না! মুড়ি ভাজা খাবো।একটু মিষ্টি হাসি দিয়ে নিষ্পাপ মুখটির আবদার।এই আবদার ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য আমার নেই। প্যান্টের পকেট থেকে পাঁচ টাকা বের করে ওর হাতে দিলাম।বয়স বোধয় ছয় বা সাত বছর হবে। ভারি মিষ্টি চেহারা। এ যেন এক রাজকন্যা।শুধু গায়ে রাজকীয় পোশাক টা নেই। হাতের কাছে ছেঁড়া একটা ময়লা জামা পড়ে আছে।আর একটা পায়জামা।হাতে কয়েকটা চুড়িও দেখলাম। পাঁচ টাকা পেয়ে তার চেহারাটা আনন্দে ভরে উঠলো।সেই চেহারাটা বর্ণনা করা সত্যিই অসম্ভব।কারণ, সেই অপরূপ চেহারা এর আগে আমি দেখিনি। ও মুড়ি নিয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে চলে গেল।খেয়াল করলাম কিছুদূরে আরো কয়েকটা ছেলে দাড়িয়ে আছে।প্রায় ওর সমবয়সী একজন আছে একটু বড়।হয়তো সে ওদের দলের সরদার।দেখলেই বোঝা যায়, চেহারায় একটু গম্ভীরতা আছে।হয়তো ওর জন্যই সবাই অপেক্ষা করছে, সবাই মিলে একসাথে ভাগ করে খাবে।সমাজ এদের নাম দিয়েছে ‘টোকাই’। মাঝে মাঝে এই শব্দটা আমার অদ্ভুত লাগে। ওরা তো আমাদের মতোই মানুষ। শরীরে সবার লাল রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে।তাহলে ওদের কেন এই নামে ডাকা হয়! কেন ওদের আমাদের মতো নিজস্ব নাম ধরে ডাকা হয় না। সেদিন আর মিষ্টি চেহারাটার নাম জিজ্ঞেস করা হলো না।হয়তো ওর একটা চেহারার মতোই মিষ্টি নাম আছে। কলেজ বাসে করে সেদিনের মতো বাসায় চলে আসলাম।এক সপ্তাহ্ পরে কলেজের খেলার মাঠে বসে আছি। আমি আর আমার কয়েকজন বন্ধু। পেছন থেকে একটা গলা ভেসে আসলো।হ্যাঁ, এই গলার আওয়াজ টা আমার চেনা, এটা সেই রাজকন্যার আওয়াজ। বললো, মামা পাঁচটা টাকা দিবেন? আমি বললাম, কি রাজকন্যা! কেমন আছো? সে একটু হতভম্ব হয়ে গেল। কিছু বললো না। সে হয়তো ভাবছে লোকটা পাগল নাকি।আমার নাম তো রাজকন্যা না। আমি বললাম, আমায় ভাইয়া বলে ডাকবা।সে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল।বললাম বসো, তোমার সাথে আমার বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দেয়।আগে বল তোমার নাম কি? সে বলল আমার নাম রিয়া! জিজ্ঞেস করলাম কোন ক্লাসে পড়ো? সে হয়তো বুঝতে পারেনি।ক্লাস শব্দটা বোধয় অজানা কিছু ওর কাছে। আমি বললাম স্কুলে যাও? রিয়া বললো না! যাই না।ওটা নাকি আমাদের জন্য না, দাদি বলেছে। আমি তো অবাক হয়ে গেলাম।জিজ্ঞেস করলাম বাড়িতে কে কে আছেন? বলল, আমার এক বুড়ি দাদি।জিজ্ঞেস করলাম, আর কেউ নেই? তোমার মা-বাবা? রিয়া বললো, না! সেই না বলার মাঝে হয়তো একটা হাহাকার ছিলো! শূন্যতা ছিলো। এতো সুন্দর একটা নাম, এতো সুন্দর একটা চেহারার মেয়েকে কিভাবে মানুষ টোকাই বলে! বললাম, কিছু খেয়েছো সকালে? বললো না! বললাম, চলো ক্যান্টিনে, তোমাকে কিছু খাওয়ায়।রিয়া বললো, তাহলে ওরা রাগ করবে যে! আমি বললাম কারা? রিয়া আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। দেখলাম কয়েকদিন আগে যাদেরকে দেখেছিলাম ওরা সবাই দাড়িয়ে আছে।আমাকে দেখে একটু অন্যদিকে তাকানোর ভান করছে। মাথা গুণে দেখলাম পাঁচজন আছে।বললাম চলো, ওদেরও নিয়ে যাচ্ছি।রিয়া আবার সেই চিরচেনা মিষ্টি হাসি দিলো।সবাই খাওয়া-দাওয়া সেরে চলে গেল।রিয়া যাওয়ার সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, তুমি অনেক ভালো ভাইয়া।কয়েকদিন পর কলেজ মাঠে বসে আছি। দেখলাম এক রাজকন্যা আসছে। স্কুল ড্রেস পড়া, কাধে স্কুল ব্যাগটাও আছে।দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বললো, ভাইয়া আমাকে কেমন লাগছে বলো? আমি বললাম, তুমি তো রাজকন্যা! রাজকন্যাকে আবার কেমন লাগে, রাজকন্যার মতোই লাগছে।জিজ্ঞেস করলাম স্কুলে গেছিলে? বললো হ্যাঁ! জিজ্ঞেস করলাম কয়জন বন্ধু হলো? রিয়া আঙুল গুণে বললো, পাঁচটা। না দাঁড়াও ভাইয়া অনেকগুলা। বন্ধু শব্দের মানে বোধয় ও বুঝে না। বললাম কেমন লাগলো, স্কুলে গিয়ে? অনেক ভালো লাগছে ভাইয়া, ওখানে সবার আমার মতো সুন্দর জামা! রিয়ার উত্তরটা সত্যিই দারুন ছিলো। আমি আর আমার কয়েকজন বন্ধু মিলে রিয়াকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলাম।আর ওর স্কুল ড্রেসটা আমার টিউশনির টাকা দিয়ে কিনে দেওয়া। কাউকে খুশি করতে পারার মাঝে যে এতো আনন্দ আছে, তা তখন বুঝতে পেরেছিলাম। এখন হয়তো রিয়াকে আর কেউ ‘টোকাই’ বলবে না।
লেখক: শিক্ষার্থী
প্রথম বর্ষ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়